‘হে অন্তর একাকী—তোমার এই বিম্বরূপখানি, তোমার কাহিনী’ (সেপ্টেম্বর ২০১০)
Description
বইটি লিখেছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে। বইটি প্রকাশ করেছিলেন ‘এবং কথা’ পত্রিকার উদ্যোগে ২০১০ সালে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এরকম একটা বই লেখার ভাবনা যাঁর মাথায় এসেছিল তিনি কতটা ব্যতিক্রমী ঘরানার মানুষ তা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা খুব মুশকিল ছিল। কেননা এই বইটির আগেও তিনি আরো কয়েকটি বই লিখেছিলেন। সবগুলোই ছিল ভিন্ন ধারার। এইরকম ধারার বইয়ের পাঠক যেমন সেই যুগেও বিরল, এই যুগেও বিরল। তাই অনেকগুলি বই লেখার পরও এই লেখককে আমরা চিনতে পারি না। সমাদারও করি না। তিনি অপঠিত, অনালোচিত, অশ্রুতই থেকে যান আমাদের কাছে। প্রায় কুড়ি বছর পর তাঁর এই বইটি আজ আমি পাঠ করলাম। বইটি কোন দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী? এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই সকলের মনে উদয় হবে। আমি প্রথমেই অবাক হয়েছি তাঁর গদ্য লেখার ভঙ্গি দেখে। বর্ণনাত্মক গদ্য হলেও তার আঙ্গিক সৌষ্ঠব, বিশেষণ, চিত্রধর্মিতা, শব্দের পৌনঃপুনিকতা, ক্রিয়া সংযোগ, গল্পকে না-গল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া খুব সহজভাবে সংঘটিত হয়েছে। না, এমন গদ্য চালে এমন কোনো সাহিত্য আমার পড়া নেই। কাহিনির একমুখীনতায় আদি-মধ্য-অন্তরূপের মধ্য দিয়েই সমাপন্তে আমি পৌঁছেছি। কিন্তু এরকম বিচ্ছিন্নতায় বহুরূপ, বহুমুখ, বহু অন্তরাল, বহু অসামঞ্জস্য এবং বহু জীবনের ক্রান্তিলগ্নগুলি সেভাবে কখনো স্পর্শ করিনি। না আত্মজীবনী, না উপন্যাস, না ছোটগল্প, না প্রবন্ধ, না রম্যরচনা কোনো পর্যায়েই যেমন একে ফেলতে পারছি না—তেমনি এক উপলব্ধির আত্মরসায়নে জারিত ডায়েরির মতো মনে হয়েছে। কখনো কল্পনা, কখনো বাস্তবতা, কখনো সচেতনতা, কখনো স্বয়ংক্রিয়তা, কখনো একাকিত্ব, কখনো বহুত্ব সবকিছুর মধ্যেই তাঁর দেখা পেয়েছি। নিজ সত্তার বহুমুখী প্রজ্ঞায় বহুমুখী অনুধাবন—কখনো চোখ, কখনো হৃদয়; কখনো মন, কখনো দেহ; কখনো নিজ, কখনো পরিপার্শ্ব; কখনো বর্তমান, কখনো অতীত ছবি উঠে এসেছে। নিজে কখনো প্রকাশ্য, কখনো আড়ালে, কখনো ব্যক্তিবাচক সর্বনামে সক্রিয় থেকেছেন। এই সেই বই ‘হে অন্তরএকাকী—তোমার এই বিম্বরূপখানি, তোমার কাহিনী’(সেপ্টেম্বর ২০১০)।লেখক স্বপন চক্রবর্তী। আমরা চিনতে পারিনি তাঁকে। নিজ অন্তরের বিম্বরূপখানি অনন্ত প্রজ্ঞায় কিভাবে ছায়াছন্ন হয়ে উঠেছে, কাহিনির চিরাচরিত রীতি ভেদ করে বিশ্বরূপখানির আঙিনায় কিভাবে তা ছড়ানো আছে সর্বকালের সর্ব মানুষে, সর্ব জীবনের প্রাপ্তি ও শূন্যতায়, অশ্রুতে ও হাসিতে তা তিনি তুলে এনেছেন। তাই একটি জীবনের একটি অভিমান বা একটি পরাজয় বা একটি সাফল্য তিনি লিখেননি; বহু জীবনের ভিড়কে চিরন্তন জীবনের মোড়কে আত্ম-অনুজ্ঞায় সংলাপবিদ্ধ করেছেন। কোথাও কোথাও কাব্য নাটকের লক্ষণ, কোথাও কোথাও নিছক কাব্য, আবার কোথাও কোথাও রূপকাশ্রিত আখ্যান হয়ে উঠেছে। সব ঘটনা, সব চিত্রকল্পের মাঝখানে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। তিনি যেমন স্মৃতির পথে হেঁটেছেন, বর্তমানের পথেও চোখ মেলে দেখেছেন। চোখের সামনে যা পড়েছে, আত্মগত উপলব্ধিতে যা সঞ্চিত হয়েছে—সেইটুকুই নিংড়ে বের করেছেন। অতি নাটকীয়তা বা জাদুবাস্তবতা বা কল্পবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হননি।
Files
Steps to reproduce
সমগ্র বইটির মূল কথা এই। কবিতার মতো বহুমুখী ব্যঞ্জনায় একান্ত নিজস্ব গদ্যে তাঁর শব্দের প্রক্ষেপণ, চিত্রকল্পের বিনির্মাণ গতিশীল হয়ে উঠেছে। একটা কথা বহু কথার জন্ম দিয়েছে। একটা অনুভূতি বহু অনুভূতির ধারক হয়ে উঠেছে। একটা দৃশ্য বহু দৃশ্যের সমন্বয়। একটা জীবন বহু জীবনের আশ্রয়। একটা কণ্ঠস্বর বহু মানুষের কন্ঠেস্বর। একটা মুহূর্ত বহু সময়ের অভিঘাতে পূর্ণ। বর্তমানের একখণ্ড আলোকে অতীতের বহু আলোক সত্তার উদ্ভাসন। স্মৃতির সরণি দীর্ঘ ও জটিল হতে হতে তার ব্যাপ্তি ও সমগ্রের সন্ধান এনে দেয়। স্থান কাল পাত্রে ছড়িয়ে যায় বহু স্থানের অনন্ত সময়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। আত্মীয়তা, পরিচিতি, মগ্নতা ও মুখরতা, একাগ্রতা ও বিচ্ছিন্নতা, সচলতা ও স্থিরতা, দার্শনিকতা ও মূর্খতা, চঞ্চলতা ও প্রৌঢ়তা, দীপ্ততা ও অন্ধকারময়তার অস্বচ্ছতা মাঝে মাঝে গ্রাস করে। মানবিক জীবনের বাঁকগুলির পুলক ও মালিন্য, দহন ও উচ্ছ্বাস, সাময়িক ও নান্দনিক প্রাচুর্যের সামনে উপনীত করে। যে জীবন সীমানায় আমাদের প্রাত্যহিক ভুবনের ক্রিয়া ও বিক্রিয়া সংগঠিত হয়, যে জীবনস্রোতে আমাদের চৈতন্যের অভিগমন ঘটে, যে অভিমান ও শূন্যতা জন্মায়, যে দার্শনিক ও মোহের, সন্ন্যাস ও ভোগের আয়োজন চলে—তারই বাঁকগুলিতে আমাদের চলমান পরিচয়টি যথাযথ চিনতে পারি। শুধু ভাষা শৈলির নিপুণ প্রক্ষেপণে,শব্দজোড়ের ও বিশেষণের মাহাত্ম্যে তা ভিন্নতর এক স্বাক্ষর বলে মনে হয়। এমন গদ্যচাল মাঝে মাঝে কাব্যকেও অতিক্রম করে যায়। রূপক ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে ভাবনা অনুভূতিকে নাড়িয়ে দেয়। চোখের সামনে তীব্র হয়ে উঠে অদৃশ্যের ক্রিয়াও। জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় অভিজ্ঞতার সংগ্রহে প্রবৃত্তি ও প্রজ্ঞার নানারূপ।