সুচেতনা: একটি মর্মভেদী প্রেমের কবিতা
Description
এই গবেষণামূলক প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাসের কবিতা 'সুচেতনা' নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এটি উত্তরোত্তর মূল্যায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্য হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে। প্রথমত, বনলতা সেন গ্রন্থের মধ্যে 'সুচেতনা' কবিতার উল্লেখ নেই, তবে দ্বিতীয় সংস্করণে এটি সংযুক্ত হয়েছে। 'সুচেতনা' কবিতাটির মাধ্যমে জীবনানন্দ দাস প্রেম, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা প্রকাশ করেন।এই প্রবন্ধে জীবনানন্দের কবিতার ভাষা, অনুভূতি, সামাজিক পরিচিতি এবং রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটির মাধ্যমে সুচেতনা কবিতার মধ্যে বিভিন্ন উচ্চারণের মতামত এবং তার আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুচেতনা কবিতাটি জীবনানন্দ দাসের কবিতা সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত করে। এটি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং মানবিক মূল্যবোধের উন্নতি ও সমর্থন করে। এটির মাধ্যমে জীবনানন্দ দাস প্রায়ই মানুষের মধ্যে প্রেম এবং বিচারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। পত্রিকা ও প্রকাশকাল সম্পর্কে ‘সুচেতনা' কবিতাটি একটু দ্বিধায় পড়তে হয় কেননা কবিতাটি ঠিক কোন্ পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার উল্লেখ নেই। আগেও কোনো পত্রিকায় বেরিয়েছিল কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (মূলত তাঁর কাব্য সমগ্র ঘেটে)। 'সুচেতনা'র মূল কাব্য গ্রন্থ হল ‘বনলতা সেন'। এই ‘বনলতা সেন' কাব্য গ্রন্থটি যখন পৌষ ১৩৪৯ এ কবিতা ভবন (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ কলকাতা) থেকে প্রকাশিত হয় (প্রথম) তখন এর অন্তর্ভুক্ত কবিতা ছিল মোট বারোটি তার মধ্যে '‘সুচেতনা' কবিতাটি ছিল না। কিন্তু বইটির যখন দ্বিতীয় সংস্কারণ (প্রথম সিগনেট সংস্করণ) বের হয় তখন আঠাশ সংখ্যক কবিতা ছিল ‘সুচেতনা’ সুচেতনা নামটি শোনা মাত্রই আমাদের হয়তো মর্মভেদী প্রেমময়ী আকাঙ্ক্ষার এক নারীর কথা মনে হতে পারে সঙ্গে এও মনে হতে পারে এ নিতান্তই প্রেমের কবিতা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনানন্দের ‘সুচেতনা' কবিতা পাঠ করা নিতান্তই আহাম্মকের কাজ করা হবে, সব চাইতে বড়ো কথা জীবনানন্দকে বা জীবনানন্দের কবিতাকে এক দৃষ্টিতে দেখেই মূল্যায়ন করতে যাওয়া ঠিক হবে না। সুচেতনা কবিতার মধ্যে একই সঙ্গে দ্বিস্তরিক চিন্তা ও ভাবনা প্রবাহিত। একদিকে বোধিসত্তাল অন্যদিকে সারাবিশ্বময় যে রাষ্ট্রনৈতিক সংকট ও সমস্যা হ’ল তার সারাৎসার মর্মবাণী—আরও বলে রাখা ভালো জীবনানন্দ নায়িকার নাম দিয়ে অনেক কবিতাই লিখেছেন কিন্তু সেই নায়িকারা তাদের ব্যক্তি নামে সার্থকতার চেয়ে ব্যঞ্জনাগত নামের সার্থকতায় ছুটেছে অর্থাৎ নায়িকা সংরক্ষিত না হয়ে মৌল সমস্যার দিকে এগিয়ে গেছে তাদের দীর্ঘবশা হাতে করে।
Files
Steps to reproduce
জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা' প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ ‘উত্তররৈবকি বাংলা কাব্য’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন—‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” তাই সুচেতনা কবিতা পর্বে–পরিচ্ছন্নকাল জ্ঞানের বিশেষ দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমেই জীবনানন্দের কবিতায় একটি দ্বিস্তরিক চিন্তা ও চেতনা থাকে তার প্রমাণ ‘সুচেতনা' কবিতাটির প্রথম স্তবক লক্ষ করলেই পরিষ্কার— সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ; সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে। এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য, তবুও শেষসত্য নয় কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে তবু তোমার কাছে আমার হৃদয়। কবিতায় শুধু এই অংশটি পাঠ করলে পাঠকের মনে হতে পারে (ক্ষণিকের হলেও) এ এক মর্মভুদ প্রেমের অভিব্যক্তি কিন্তু তা নয়। সুচেতনা অর্থে আমরা যাকে প্রেয়সী রূপে কল্পনা করতে চাইছি সে কোনো নাম বাচক বিশেষ্যপদ নয় সে হ’ল বিশেষণ। সুচেতনার অর্থ শুভচেতনা। সারিয়ে না তুললে ধীরে ধীরে অসুখ বাড়তেই থাকে। সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রধারা। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় তার প্রতিভার মতামত এবং বিশেষ সম্মিলিত সুচিস্তার মতামতের দ্বারা। কিন্তু অক্ষমের গান—বিশ্বের মিলিত চিন্তাই যখন বিফল হয়ে মেতে ওঠে ধুন্ধুমার দাঙ্গামায় তখন অসুখ গভীর হয়ে ওঠে। তাই কবি একত্র উচ্চারণ করেছেন— আমার চোখের সামনে আনিয়োনা সৈন্যদের মশালের রং দামামা থামায়ে ফেলো-পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ্। কিন্তু জীবনানন্দ তবুও নিজের অভিমত দিয়েছেন—‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে। রিলকে তার ‘Ninth Elegy’তে ক্ষণস্থায়িত্ব থেকেই প্রশ্নচ্ছলে উত্তর খুঁজেছিলেন—'Can it ever be cancelled' জীবনানন্দও বলেছেন ‘....তবুও ঋণী' অর্থাৎ অপূর্ণতা সত্ত্বেও এই জগৎ বর্জনীয় নয় এবং বর্জনীয় নয় এইজন্য যে, যা মানুষের জীবনের বর্জ্য পদার্থের সমতুল চিন্তা, তাকে সময় দিতে হয় কেননা বর্জ্য পদার্থ পচে একসময় সার পদার্থ তৈরি হয়। Thomas Hardy তাঁর 'In Time of the Breaking of Nations' কবিতায় বলেছেন যুদ্ধ থাকবে, মৃত্যু থাকবে, প্রেম থাকবে, কর্মও থাকবে, কোনো কিছুর জন্যই কোনো কিছু আটকে যাবে না। সমস্ত কিছুই সঞ্চারমান, একটির জন্য আর একটি বন্ধ হবে না। একে অন্যের পরিপূর্বক তবে নাও হতে পারে, সুতরাং চলমানতাই শেষ কথা। তাই তৃতীয় স্তবকে কবি যখনই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেন—'কেবল জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে/দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয় ;/ সেই শস্য অগণন মানুষের শব/ শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়/ সমস্তই খেটে খাওয়া Proletarian-রা রক্ত ঘামের বিনিময়ে উৎপন্ন করে এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের হার বৃদ্ধি করে কিন্তু তারাই শেষ পর্যন্ত সর্বস্বান্ত, ক্লান্ত অনাহূত হতাশের দল। চিন দেশের জ্ঞানী পুরুষ কনফুসিয়াসের মতো ব্যক্তিত্ব যেমন নীরব থাকেন তেমনি আমাদের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীলদেরও এই শোষণ উৎপীড়নের যন্ত্রণা দেখে মূক হয়ে নীরবতা পালন করতে দেখি। কিন্তু পৃথিবী চলমান সূর্য উঠবেই Continuation-ই শেষ কথা তাই—–‘তবু চারিদিকে রক্ত ক্লান্ত কাজের আহ্বান' 'তবু' মুক্তি সম্ভব হবে সুচেতনাকে সাথী করে। এই পথে আলো জ্বেলে—এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি' হবে অর্থাৎ এই পৃথিবীর সন্ধান একমাত্র কাজের পথ, কিন্তু জীবনানন্দ লক্ষ করেছেন কাজের মধ্যে দিয়ে হলেও সে সুদূরপ্রসারী এক প্রকল্প, হঠাৎই হয়ে উঠবে না। বৃহত্তর রোগ ধরা পড়ার পরই সেটা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয় এবং হঠাৎ-ই সারিয়ে তুললে তা পুনরায় ভঙ্গুর হয়। ......