বিরোধী ভাবধারা ও প্রতিবাদের ভাষায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা : একটি বিশ্লেষণী পাঠ
Description
বিংশ শতকের চল্লিশ দশকের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একদিকে মানব দরদী অন্যদিকে প্রতিবাদী। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হলেও শৈশব থেকেই গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর রচিত বেশির ভাগ কবিতার মধ্যেই রয়েছে প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের ভাষা। অন্যায়কে তিনি কখনো আপস করেন নি। জীবনে চলার পথে যেখানেই তিনি অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রতিবাদের ভাষা। আর এই প্রতিবাদের ভাষাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন তাঁর করিতায়। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তে-ভাগা আন্দোলন, ১৯৫৯ থেকে খাদ্য আন্দোলন, চীন- ভারতের যুদ্ধ, পুলিশ ও মহাজনদের অত্যাচার, মে দিবসের রক্তাত্ত ইতিহাস তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা সমসাময়িক কালের দলিল; আবার বলা যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রতিবাদের অস্ত্র। যে কারনে হয়তো শঙ্খ ঘোষ বীরেন্দ্র সমগ্রে, ১ম খণ্ডের সূচনায় বলেছেন- "সমস্ত অর্থেই বাংলার সবচেয়ে প্রতিবাদী এই কবি; তাঁর কবিতা যেন আমাদের সামনে একটা সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরে, আমাদের হৃদয়ের ইতিহাস আর আমাদের সময়ের ইতিহাস"। যন্ত্রনাদগ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানব দরদী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাম্যবাদী আদর্শে নতুন এক ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যারা আকাশ বিষাক্ত করে, জল কালো করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায় ক্রমে অন্ধকার করে, চারিদিকে ষড়যন্ত্র করে; তাদের উদ্দেশে কবি "আমার ভারতবর্ষ" করিতায় উল্লেখ করেছেন- “আমার ভারতবর্ষ চেনেনা তাদের মানেনা তাদের পরোয়ানা তাঁর সন্তানেরা ক্ষুধায় জ্বালায়, শীতে চারিদিকের প্রচণ্ড মারের মধ্যে আজও ঈশ্বরের শিশু, পরস্পরের সহোদর।” কৈশোরকাল থেকেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারা স্পষ্ট হতে থাকে এবং ১৯৪২ এ তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্বিরোধ এবং পার্টির বিভাগ কবিকে আন্দোলিত করে এবং তাঁর ফলে কবির মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিবাদী স্বভাব। এ প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠ কাব্যের ভূমিকায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যাইয়ের বক্তব্য- "অনুভব কোন প্রশ্নের উত্তর নয়। সময়, স্বদেশ, মনুষ্যত্ব কবি কবিতা, কবিতার পাঠক কোথাও যদি এক্সুত্রে বাঁধা যেতো? হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। "আর এই অনেক প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করতেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মধ্যে উঠে এসেছে প্রতিবাদের ভাষা, সুর, আদল। মানুষের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই অনেক প্রশ্ন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী শোষিত, লঞ্চিত, অবহেলিত, বুভুক্ষ, নিরন্ন মানুষদের ন্যূনতম অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অভাব দেখে কবির কলমে উঠে এসেছে প্রতিবাদ। শতবর্ষে পরেও আজ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা কেন পাঠ্য? আজকের সামাজিক অবস্থা, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন, রাজনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'রাজা আসে যায়' কবিতার কয়েকটি পংত্তি এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে- “রাজা আসে যায় রাজা বদলায় নীল জামা গায় লাল জামা গায় এই রাজা আসে ওই রাজা যায় জামা কাপড়ের রং বদলায় দিন বদলায় না।” সত্যিই! দিন যেন বদলায় নি। জীবনে যাপনে সমাজে সভ্যতায় সাধারন মানুষকে আজও যে অত্যাচারের, অবিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা পাঠককে অবগত করার অবকাশ নেই। 'রাজনীতি' শব্দের অর্থ রাজার নীতি। কিন্তু এই নীতি যখন রাজতন্ত্রের, পুঁজিবাদীদের, শাসক সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারন মানুষের জন্য সহজ...........
Files
Steps to reproduce
স্বদেশের বিপন্ন পরিস্থিতিতে জনগণের বিবেক ও মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখতে চেয়েছিলেন 'কবি। তিনি অনুভব করেছিলেন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধই পারে সুন্দর স্বতিময় সমাজ ব্যবস্থা গড়তে। আশাবাদী কবি তাই স্বদেশ প্রেমের মহিমায়, প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে নবজীবনের গান গেয়েছিলেন। তারই প্রমাণ পাই ‘আন্তর্জাতিক প্রহসন নয়, সত্তিকারের পৃথিবীর জন্য’ কবিতায়- “একটা পৃথিবী চাই - শুকনো কাঠের মত মায়েদের শরীরে কান্না নিয়ে নয় তাদের বুকভর্তি অফুরন্ত ভালোবাসার শস্য নিয়ে।” মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন কবি। জীবনের ও সমাজের সব সংকট, অস্বস্তি, অশান্তি, অসহায়তার অবসান ঘটাতেই যেন কবির আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলা কাব্য জগতে। কবি শঙ্খ ঘোষ তাই বলেছেন- 'সত্তর সালের অল্প আগে থেকে সমস্ত দশকজুড়ে জেগে উঠতে থাকে তার ক্ষুব্ধ মুখ্যচ্ছবি, সমস্ত ভন্ড তা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের বিবেক ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর বিরামহীন প্রতিবাদে। সেই প্রতিবাদে কাব্য রীতির অনেক পুরনো শর্ত নিশ্চয়ই ভেঙে ফেলেন তিনি, ভেঙে ফেলেন ছন্দ প্রতিমার অনেক প্রাক-সংস্কার, শিল্পিত কবিতা লেখা হলো না বলে ছন্দ বিলাপও করেন কখনওবা। নিরাভরণ ঘোষনার ভাষাই বা পথচলতি দৈনন্দিন রূঢ়তায় ছড়িয়ে দেন তিনি কবিতা, আর কবিতা বিচারের এক নতুন মানে তখন আমাদের তৈরি করে নিতে হয়। তাঁরই কবিতার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ সামনে রেখে। 'তাই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সমসাময়িক সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে আজও শ্রমজীবী মানুষের নতুন পৃথিবী গড়ার অন্যতম পথ ও পাথেয় হিসেবে আমাদের কাছে অনবদ্য ভূমিকা অবতীর্ণ হয়ে থাকবে।