বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

Published: 26 February 2024| Version 1 | DOI: 10.17632/bf9nbsctnj.1
Contributor:
Md Siddique Hossain Md Siddique Hossain

Description

অক্ষয় কুমার দত্তের সমসাময়িক কালে বিজ্ঞানের সাধারণ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে যারা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম। বিদ্যাসাগর প্রণীত জীবনচরিত এ বিজ্ঞানীদের জীবনীর উল্লেখযোগ্য স্থান আছে। এই গ্রন্থে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, হর্সেল প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের জীবনী অতি সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রথম বাংলা গ্রন্থে বিজ্ঞানীদের জীবনচরিত আলোচনার প্রচেষ্টা বিদ্যাসাগর রচিত জীবনচরিত এ প্রথম দেখা গেল। যদি যদিও জীবনচরিতের বিষয়বস্তু বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও অনুবাদিত তবুও তা হুবহু অনুবাদ করা হয়নি। এই গ্রন্থ পাঠ করে, মহাপুরুষদের জীবনী পড়ে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে এই আশায় বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বিশ্রুত গ্রন্থ বোধোদয় (শিশুশিক্ষা, ৪র্থ ভাগ)-এর অধিকাংশ অংশ জুড়েই প্রাথমিক প্রকৃতির বিজ্ঞান-প্রসঙ্গ। বোধোদয় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছিল। তবে বোধোদয় রচিত হয়েছিল মূলত চেম্বার্স রুডিমেন্টস্ অব নলেজ নামক গ্রন্থের অনুকরণে। বোধোদয় সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এর ঝরঝরে ভাষা এবং স্বল্পপরিসরের মধ্যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কয়েকটি প্রধান প্রধান বিভাগের সমাবেশ। প্রাণীবিদ্যা, শারীরবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং ভূগোল ও ভূবিদ্যা -বিষয়ক বহু প্রবন্ধ এতে আছে। ‘বেধোদয়’-এর বৈজ্ঞানিক রচনাগুলিকে পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান-প্রবন্ধ বলা না গেলেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় অধিকাংশ রচনায়ই সুস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ 'চেতন পদার্থ' শীর্ষক রচনাটির নাম করা যায়। আলোচনা এখানে একেবারেই প্রাথমিক প্রকৃতির এবং খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই আলোচনায় একটি পরিকল্পিত ইঙ্গিত রয়েছে। এখানে একে একে জীব জন্তু, পাখি, মাছ, সাপ, পতঙ্গ ও কীট নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত প্রকৃতির আলোচনা করা হয়েছে। জীবজগতের বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিভাগের কথা লেখক আলোচনার প্রারম্ভে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করলেও বিষয়বস্তুর এই বিন্যাস দেখে সহজেই বোঝা যায়, রচনার সময়ে বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর সচেতন ছিলেন বিজ্ঞানের জটিলতা এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস বোধোদয়-এর রচনাগুলির আর-একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেমন, স্বর্ণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ‘আপেক্ষিক গুরুত্ব’ কথাটির উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, “স্বর্ণ জল অপেক্ষা উনিশ গুণ ভারী”। তা ছাড়া বিভিন্ন ইন্দ্রিয় সম্পর্কে আলোচনায় শারীরবিজ্ঞান -বিষয়ক নামগুলি বিদ্যাসাগর এড়িয়ে গেছেন। কোনো কোনো প্রসঙ্গে এদেশীয় রীতি অনুসৃত। যেমন, কাল এবং বস্তুর আকার ও পরিমাণ সম্বন্ধে আলোচনায়। বোধোদয়-এর কোনো কোনো অংশ গল্পের মতো সুখপাঠ্য। ‘মানবজাতি’ শীর্ষক রচনাটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ‘বোধোদয়’ একটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থ। শিশুপাঠা গ্রন্থে বিজ্ঞান-প্রসঙ্গের অবতারণা একেবারে নতুন নয়। বিদ্যাসাগরের আগেও রাধাকান্ত দেব এর বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ-এ এর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বোধোদয়-এ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সরল ভাষায় বিজ্ঞানের অতি সাধারণ ও পরিচিত প্রসঙ্গগুলি লিপিবদ্ধ করলেন, তা তখনকার যুগের বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে একেবারে অভিনব।

Files

Steps to reproduce

‘বোধোদয়’-এর রচনার বিশেষত্বের একটি নিদর্শন ; ‘কাচ’ শীর্ষক রচনাটির একাংশ - ‘কাচ অতি কঠিন, নিৰ্ম্মল, মসৃণ পদার্থ, এবং অতিশয় ভঙ্গ প্রবণ, অর্থাৎ অনায়াসে ভাঙ্গিয়া যায়। কাচ স্বচ্ছ, এ নিমিত্ত, উহার ভিতর দিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। ঘরের মধ্যে থাকিয়া, জানালা ও কপাট বন্ধ করিলে, অন্ধকার হয়, বাহিরের কোনও বস্তু দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সাসি বন্ধ করিলে, পূর্বের মত আলোক থাকে, ও বাহিরের বস্তু দেখা যায়। তাহার কারণ এই, সাসি কাচে নিৰ্ম্মিত, সূর্য্যের আভা, কাচের ভিতর দিয়া, আসিতে পারে, কিন্তু কাষ্ঠের ভিতর দিয়া আসিতে পারে না। বালুকা ও একপ্রকার ক্ষার, এই দুই বস্তু একত্রিত করিয়া অগ্নির উৎকট উত্তাপ লাগাইলে, গলিয়া উভয়ে মিলিয়া যায়, এবং শীতল হইলে কাচ হয়। বালুকা যে রূপ পরিষ্কার থাকে, কাচ সেই অনুসারে পরিষ্কার হয়। কাচে লাল, সবুজ, হরিদ্রা প্রভৃতি রঙ করে; রঙ করিলে, অতি সুন্দর দেখায়। কাচ অনেক প্রয়োজনে লাগে। সাসি, আরসি, সিসি, বোতল, গেলাস, ঝাড়, লণ্ঠন, ইত্যাদি নানা বস্তু কাচে প্রস্তুত হয়। কাচ কোনও অস্ত্রে কাটা যায় না, কেবল হীরাতে কাটে। হীরার সূক্ষ্ম অগ্রভাগ কাচের উপর দিয়া টানিয়া গেলে, একটি দাগ পড়ে। তার পর জোর দিলেই, দাগে দাগে ভাঙ্গিয়া যায়। যদি হীরার অগ্রভাগ স্বভাবতঃ সূক্ষ্ম থাকে, তবেই তাহাতে কাচ কাটা যায়। যদি হীরা ভাঙ্গিয়া, অথবা আর কোনও প্রকারে উহার অগ্রভাগ সূক্ষ্ম করিয়া, লওয়া যায়; তাহাতে কাচের গায়ে আঁচড় মাত্র লাগে, কাটিবার মত দাগ বসে না’। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ অঙ্কবই প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর পাটীগণিত (১২৬২ ব.)। বাংলা পাটিগণিতের পথপ্রদর্শক প্রসন্নকুমার। বাংলা ভাষায় গণিতের পরিভাষার সৃষ্টি সর্বপ্রথম তিনিই করেছিলেন।প্রসন্নকুমারের পাটীগণিত-এর বিষয়বস্তু কোলেন্সো, নিউ মার্চ, চেম্বার্স প্রভৃতির গ্রন্থ থেকে সংকলিত। তাঁর পাটিগণিত বইতে গাণিতিক শব্দগুলোর সংকলনে সাহায্য করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় বীজগণিত রচনার সূত্রপাত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে বীজগণিত রচনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রসুন্ন কুমার বাংলায় পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে প্রথম বীজগণিত লিখলেন, প্রসন্নকুমারের বীজগণিত (প্রথম ভাগ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ ও দ্বিতীয় ভাগ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ)। যদিও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য পুস্তক প্রবর্তনের গোড়াপত্তন করেছিলেন ইউরোপীয়েরা। কিন্তু ইউরোপীয়দের বাংলা ভাষা ছিল কৃত্রিম ও জটিলতায় ভরা। ভাষার কৃত্রিমতা দূর করে এদেশীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে যারা সচেষ্ট ছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামটিও স্মরণে রাখতে হবে।

Institutions

Bangabasi Morning College

Categories

Research Article

Licence