রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পে ভৃত্যদের ভূমিকা উন্মোচন: সামাজিক শ্রেণী, ত্যাগ এবং ঔপনিবেশিক প্রভাবের উপর একটি দৃষ্টিকোণ
Description
সারসংক্ষেপ: বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সার্থক ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে গিয়ে মানুষকে ধারণ করেন। সমাজের নিম্নস্তরে অবস্থিত ভৃত্য বা গৃহভৃত্য তাঁর ছোটগল্পগুলিতে তাৎপর্যবহ চরিত্রে হাজির হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের গৃহের অপরিচ্ছন্ন কোণ থেকে বের করে দৃষ্টির সম্মুখভাগে হাজির করেন। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বাবুদের শান্তি ও স্বস্তি বিধানে উৎসর্গীকৃত এই ভৃত্যদের জীবন ও কর্মপরিধি উল্লিখিত হয়েছে বর্তমান প্রবন্ধে। ইতিহাসে অবহেলিত এই শ্রেণি কীভাবে বাঙালি মধ্যবিত্তের গৃহে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল সেটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে ছোটগল্পগুলি পর্যালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পগুলির মাধ্যমে ভৃত্যদের যে অবদান প্রতিপাদন করেন- সেটি নির্ণয় করা আলোচ্য প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। ভৃত্যদের আন্তরিকতা ও ত্যাগকে প্রভুরা মূল্যায়ন করে কেবল স্বার্থগত দৃষ্টিকোণ থেকে। সামন্ত ও আধা-সামন্ত প্রভুদের এই মনন ঔপনিবেশিক প্রভাবজাত-এই প্রত্যয়টি অনুসন্ধান করা গবেষণা কর্মটির প্রধান উদ্দেশ্য। গবেষণা কর্মটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিচার ও মূল্যায়নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হবে এবং সাহিত্যে ভৃত্য-প্রসঙ্গটি চর্চিত হবে। যা সমাজ বিন্যাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
Files
Steps to reproduce
গল্পে পাওয়া যায়: মনোহরলালের যে চাকরটি আছে, রামচরণ, তাহার শরীররক্ষা ও শরীরপাতের একমাত্র লক্ষ্য বাবুর দেহ রক্ষা করা। যদি সে নিশ্বাস লইলে বাবুর নিশ্বাস লইবার একমাত্র প্রয়োজনটুকু বাঁচিয়া যায় তাহা হইলে সে অহোরাত্র কামারের হাপরের মতো হাঁপাইতে রাজি আছে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১৬ঘ: ১২৬) আর এই আনুগত্যের জন্য তাকে বাধ্য করা হয়নি, এতেই তার আনন্দ। রবীন্দ্রনাথ পূর্বেই বলে দেন: "পৃথিবীতে একদল লোক জন্মায় সেবা করাই তাহাদের ধর্ম।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১৬ঘ: ১২৬) লেখক বিশেষ ভূমিকা ছাড়াই রামচরণের এই প্রবল প্রভুভক্তি তথা দাসত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বিষয়গুলিকে মনোগত তুষ্টি বা ভারতবর্ষীয় মহান দর্শন বলে দায় মেটানো যায় না। এর নেপথ্যের কারণ- রামচরণদের জন্য এর চেয়ে উত্তম জীবন কল্পনীয় নয়। নিয়তি রূপে এটুকু তাদের প্রাপ্তি; যেমন: হাত হইতে গুড়গুড়ির নলটা হয়তো মাটিতে পড়িয়াছে, সেটাকে তোলা কঠিন কাজ নহে, অথচ সেজন্য ডাক দিয়া অন্য ঘর হইতে রামচরণকে দৌড় করানো নিতান্ত বিসদৃশ বলিয়াই বোধ হয়। কিন্তু এই সকল ভুরি-ভুরি অনাবশ্যক ব্যাপারে নিজেকে অত্যাবশ্যক করিয়া তোলাতে রামচরণের প্রভৃত আনন্দ। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১৬ঘ: ১২৬) রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনিয়মিত চরিত্র বিষয়ে জ্যোতির্ময় রায় বলেন: অভিজাত ধনী সম্প্রদায়ের বাইরে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের চরিত্র গড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দৈনন্দিন খুঁটিনাটি ঘটনার জোরে অতি-বাস্তব হয়ে ওঠেননি, এমন ঘটনা বিরল নয়: যে সব ক্ষেত্রে চরিত্র বা পরিবেশকে আংশিকভাবে কাল্পনিক বলা যেতে পারে। কিন্তু কাল্পনিক বলেই তারা ব্যর্থ নয়, কারণ তাঁর রচনায় মৌলিক সত্য কোথাও ব্যাহত হয়নি।" (জ্যোতির্ময় রায়, কবিতা ১৩৪৮: ৭১) যা সাধারণের অভিজ্ঞতার বাইরে তাকে সচরাচর কাল্পনিক আখ্যা দেয়া হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ এইসব চরিত্রগুলির অন্তর এমন স্বচ্ছভাবে চিত্রিত করেছেন যে তাদের সর্বদা বাস্তবের সীমারেখার মাঝে পাওয়া যায়। তেমন এক অনিয়মিত চরিত্র 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন'র রাইচরণ। প্রগাঢ় দরদ ও মানবিক অনুভূতি দিয়ে লেখক চরিত্রটি সৃজন করেছেন। তাঁর মূল পরিচয় গৃহভৃত্য। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মৌল সত্যের জোরে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম এক চরিত্র রাইচরণ। জাতিতে কায়স্থ রাইচরণ তার প্রভুর কাজে যোগ দেয় কিশোর বয়সে। প্রভুর তিন পুরুষের সেবায় রাইচরণ জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গ করে। তবু বেইমানি ও চুরির অপবাদে তাকে ফেরারি হতে হয়। গল্পগুচ্ছ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেন: "ঘটনা যেখানে খুব জমকালো ধরনের, সেখানেই রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে নিচু গলায় কথা বলেন এবং বলেন সবচেয়ে কম।" (বুদ্ধদেব বসু, ১৯৬৬: ৫৪) আর তাই রাইচরণের স্বচ্ছ, সরল, সুকঠিন ও উদার মনের পরিচিতিতে বিস্তৃতি ঘটান না। খুব সাধারণভাবে ঘটনা বিধৃত করেন। অনুকূলবাবুকে শিশুকাল হতে পরিণত বয়স পর্যন্ত দেখভাল, পরিচর্যা অতঃপর তার সন্তানের ভারগ্রহণ করেন রাইচরণ। পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহে সেই শিশুটির সলিল সমাধি ঘটে, যার সম্পূর্ণ দোষ বর্তায় রাইচরণের উপর। পরবর্তী সময়ে রাইচরণের এক পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তার সংস্কারাচ্ছন্ন মন বলে, তার প্রভু-পুত্র বুঝি তার সন্তান হিসেবে এসেছে। তার উপলব্ধি: "আহা, মায়ের মন জানিতে পারিয়াছিল তাহার ছেলেকে কে চুরি করিয়াছে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১৬ক: ৩০৪) আর তাই পৈত্রিক জমি, স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে বাবুদের ছেলের মতো করে গড়ে তোলে নিজ সন্তানকে। প্রভুকে পুত্রহীন রেখে নিজে পুত্রসুখ ভোগ করতে রাইচরণের ভয়ানক আপত্তি। পুত্রের সাথে সে প্রভু-ভৃত্যের ন্যায় সম্পর্ক গড়ে তোলে। বৃদ্ধ বয়সে অনুকূলবাবুর নিকট গিয়ে জবান দেয় "আমিই তোমাদের ছেলেকে চুরি করিয়া লইয়াছিলাম।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১৬ক: ৩০৫) প্রভুর কাছে ............