অসাম্প্রদায়িকতার আলোকে সরস্বতী পুজো: একটি বিশেষ সংবাখ্যান
Description
আজ সরস্বতী পূজা। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। সরস্বতী হলেন জ্ঞান, বিদ্যা, সংস্কৃতি ও শুদ্ধতার দেবী। সৌম্যাবয়ব, শুভ্র বসন, হংস-সংবলিত, পুস্তক ও বীণাধারিণী এই দেবী বাঙালির মানসলোকে এমন এক প্রতিমূর্তিতে বিরাজিত, যেখানে কোনো অন্ধকার নেই, নেই অজ্ঞানতা বা সংস্কারের কালো ছায়া। সরস্বতী দেবীকে হিন্দুরা পুজো করলেও অধিকাংশ বাঙালির কাছে ‘বিদ্যা’ নামক অব্যাখ্যাত শব্দটির প্রতীক এই সরস্বতী। দেশ ও জাতির উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সনাতন ধর্মে শিক্ষাকে উঁচু স্তরে আসীন করা হয়েছে। এ ধর্মে প্রাচীন ঋষিরা ব্রহ্মের অনন্ত শক্তির অংশকে একেকজন দেব-দেবীরূপে কল্পনা করেছেন। আর তেমনিভাবে ব্রহ্মের যে শক্তি আমাদের বিদ্যা শিক্ষাদান করেন, তাকে সরস্বতী দেবী নামে পূজা-অর্চনা করা হয়। শাস্ত্রে দেখা যায়, চতুর্ভুজা ব্রহ্মার মুখ থেকে আবির্ভূতা শুভ্রবর্ণা বীণাধারিণী চন্দ্রের শোভাযুক্তা দেবীই হলেন সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর ধ্যান, প্রণামমন্ত্র ও স্তবমালা থেকে সামগ্রিক রূপটি হল ‘এই দেবী সরস্বতী শুভ্রবর্ণা শ্বেত পদ্মাসনা, শ্রী হস্তে লেখনী, পুস্তক ও বীণা। তিনি শুভ্রবস্ত্রাবৃতা হংসরূপ বাহনে উপবিষ্ট বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তাদি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।’ পুরাণে সরস্বতী দেবীর উদ্ভব নিয়ে নানা প্রসঙ্গ আছে। ঋগে¦দের দশম মণ্ডলে ঋষি মধুছন্দা গায়ত্রী ছন্দে সরস্বতী দেবীকে বন্দনা করেছেন গতিময় জীবন প্রত্যাশা করে। সংস্কৃত ‘সরস’ হল পূর্ণতাপ্রদাত্রী বা জ্যোতির্ময়ী অথবা ঐশর্যময়ী। আবার ‘সরস’ অর্থ জল বা জীবনের প্রশান্তি। উভয় অর্থেই (সরস+বতী) সরস্বতী আলোকিত জীবনময়তার প্রতীক। শাস্ত্রে বিভিন্নরূপে সরস্বতী দেবীর পূজার কথা বর্ণিত আছে। হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদে নদীরূপে, যজ্ঞ কর্মাদিতে প্রজ্ঞাদাত্রীরূপে, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ কর্ণৎভবা বাগাধিষ্ঠাত্রীরূপে, শ্রীহরির ভাষারূপে, মৎস্যপুরাণে নৃত্য-গীতাদির সিদ্ধিদাত্রীরূপে সরস্বতীর কথা বর্ণিত আছে। বেদাস্ত শ্রুতিতে জ্ঞান মোক্ষদা বলে ব্রহ্মা তার স্তুতি করেছেন। দেবর্ষি নারদ তাকে বলেছেন জগন্ময়ী, ব্রহ্মময়ী, কোটিন্দুমুখী। ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলেছেন, জ্যোতিরূপা সনাতনী পরমা ব্রহ্মস্বরূপা। বর্তমানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দ্বারা সরস্বতী বিদ্যা, জ্ঞান, সঙ্গীত ও কলাধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে পূজিত, বন্দিত ও চর্চিত হন। সরস্বতী দেবীর স্বরূপ সম্পর্কে সরস্বতী স্তোত্রে বর্ণিত আছে, ‘শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষশোভিতা/ শ্বেতাম্বর ধরা নিত্যেমবেত গন্ধানু লেপনা/ মানসে রমতাং নিত্যং হংসেব হংস বাহিনী/ বাচং দদাতি বিপুলাং যা চ দেবী সরস্বতী।’ সরস্বতী শ্বেত পদ্মের ওপর উপবিষ্টা। সাধকদের মতে, দেহে ছয়টি পদ আছে। বিশুদ্ধ পদে আরোহণ করলে সারস্বত জ্ঞান লাভ হয়। সরস্বতীকে পদ্মাসীনা দেখিয়ে দেহস্থ প্রাণবায়ুকে উত্তোলন করার কৌশল নির্দেশ করা হয়েছে। তিনি শুভ্রবর্ণা। তার এই শুভ্রবর্ণ শুচিতা, শুভ্রতা, শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক; যা আমাদের মনকে শুচি, শুভ্র ও শুদ্ধ রাখার নির্দেশ দিচ্ছে। কারণ মনশুদ্ধি না হলে চিত্তশুদ্ধি হয় না আর চিত্তশুদ্ধি ছাড়া জ্ঞান লাভ করা যায় না। সরস্বতী দেবী হংসবাহনা। হংসের একটি বিচিত্রতা আছে। হংসকে দুধ ও জলের মিশ্রণ খেতে দিলে সে অনায়াসে জল রেখে সারবস্তু দুধ গ্রহণ করে। সার ও অসার মিশ্রিত এই জগৎ সংসারে মানুষ যেন সারবস্তু গ্রহণ করে এ নির্দেশই হংসবাহনতায় প্রকাশিত। দেবীর হাতের পুস্তক জ্ঞানচর্চার প্রতীক। জ্ঞানের মতো পবিত্র এ জগতে আর কিছুই নেই। ...............