জমিন্দারির পুনঃনির্ধারণঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধায়কত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিবর্তন
Description
রবীন্দ্রনাথকে জমিদার হওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার ও উপেক্ষা করার সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন বিরল প্রতিভার মানুষ। তিনি নানা দিকে বিশাল ব্যবসা বাণিজ্যের স্থপতি ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে এ বিষয়ে সারা ভারতেই পথিকৃৎ বলা যায়। বিপুল ধন সম্পত্তির মালিক হয়েও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন যে তাঁর উত্তরাধিকারীদের এই সব ব্যবসা সার্থকভাবে পরিচালনা করার যোগ্যতা নেই। তাই প্রথমবার বিলেত যাবার আগে ১৮৪০ সালের ২০ অগস্ট তারিখে তাঁর যাবতীয় জমিদারি একটা ট্রাস্ট ডিড় করে সুরক্ষিত করে রেখে গিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে জোড়াসাঁকোর বসত বাড়ি আর দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়িটিও তিনি সুরক্ষিত করে গিয়েছিলেন। মাত্র ৫২ বছর বয়সে ইংলন্ডে দ্বারকানাথের জীবনাবসানের পর তাঁর বিশাল ব্যবসায়ী সাম্রাজ্যের পতন হতে শুরু করে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া বিস্তীর্ণ জমিদারি রক্ষা পায়। এবং এই জমিদারির সাহায্যে তাঁর উত্তরাধিকারীগণ জীবন ভোর আর্থিক সচ্ছলতা ভোগ করে গেছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের জমিদারির অন্তর্গত ছিল নদিয়ার বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ, পাবনা জেলার সাজাদপুর এবং রাজশাহীর কালীগ্রাম পরগণা। কালীগ্রাম পরগণার সদর ছিল পতিসর। উড়িষ্যা ও অন্যান্য জায়গায়ও দ্বারকানাথের কিছু জমিদারি ছিল। পরিবারের জ্যেষ্ঠতম হিসাবে দেবেন্দ্রনাথ এজমালির সম্পত্তি যাবতীয় জমিদারির দেখাশুনা ও তত্ত্বাবধানের কাজ পরিচালনা করতেন।তারপর দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ্যপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব পান। সবশেষে এই দায়িত্ব পান রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য প্রথমেই এই দায়িত্ব পান নি পেয়েছেন পুরো পাঁচ বছর শিক্ষানবিশি এবং ইনস্পেকশনের অভিজ্ঞতার পর। ১৯৮০ সালে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারির কাজ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথের কাজ ছিল সদর কাছারিতে নিয়মিত উপস্থিত থেকে প্রতিদিনের আয় ব্যয় ও হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখে তার সারমর্ম নোট করে রাখা এবং প্রতি সপ্তাহে তার রিপোর্ট পিতৃদেবকে পাঠান এবং তার ওপর পিতৃদেবের উপযুক্ত উপদেশ মত কাজ করা। দেবেন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন যে রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা ও বিচক্ষণতার উপযুক্ত পরিচয় পেলে তবেই তাঁর ওপর জমিদারির দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই কঠোর শিক্ষানবিশির কাজ খুবই দুশ্চিন্তার ছিল। কারণ দেবেন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি বিষয়ের খুটিনাটি খুব ভাল করে বুঝে নিতেন কোনও কিছু এদিক সেদিক হবার উপায় ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৫ সালের ৮ আগস্ট "পাওয়ার অব এটর্নির" মাধ্যমে পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে সমগ্র এজমালির জমিদারি সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব পান অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি জমিদার রূপে নিযুক্ত হন। অন্যান্য কোন কোন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু অনভিপ্রেত দিক থাকলেও জমিদার হিসাবে তিনি ছিলেন অনন্য। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, "এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।” পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিষটার 'পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি জমিদারি জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব। আমরা পরিশ্রম না করে, উপার্জন না করে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না করে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি। যারা বীর্যের .....
Files
Steps to reproduce
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি ও জমিদারের কনসেপ্ট বা ধারনাই পাল্টে দিয়েছিলেন। প্রজাদের জন্য তাঁর দরজা সব সময়েই খোলা থাকত। সকাল দপর রাত্রি যে কোনও সময় কবির কাছে প্রজারা তাদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতে পারত। কবিও ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনতেন ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ জমিদারিকে আর পাঁচটা ব্যবসার মতই পরিচালনা করতেন। যদিও তিনি দেখতেন এবং নির্দেশ দিতেন যেন তাঁর জমিদারিতে প্রজা পীড়ন না হয়। দেবেন্দ্রনাথের কাছে জমিদারি ছিল খাজনা আদায়ের উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জমিদারি শুধু খাজনা আদায়ের যন্ত্র ছিল না; তিনি ছিলেন প্রজাদের প্রকৃত বন্ধু ও অভিভাবক। তাই জমিদার রবীন্দ্রনাথকে আমরা অন্যান্য জমিদার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ প্রচেষ্টায় জমিদারির চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছিল। বড় বড় রাস্তা তৈরি হ'ল, মন্দির দরগার সংস্কার হ'ল, ঘরে ঘরে তাঁত বসল, উন্নত ধরনের কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন হ'ল, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হ'ল, মাদ্রাসা, টোল-স্কুল বসল, ঋণ সহজলভ্য হ'ল, উৎপাদিত ফসল সহজে বিক্রয়ের ব্যবস্থা হ'ল, বিনা খরচে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা হ'ল– এক কথায় প্রজাদের জীবন যাত্রার পদ্ধতিই পাল্টে গেল। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। বাংলা তথা ভারতের পরম সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথের উপর জমিদারি পরিচালনায়র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। এর ফলে কলকাতা নিবাসী কবি নদীমাতৃক বাংলার রূপটি সযত্নে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। শস্য শ্যামলা বাংলার উন্মুক্ত আকাশ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, নদীর কলধ্বনি-রূপসী বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল এবং কবির রাশি রাশি অমূল্য সাহিত্য সম্পদ সৃষ্টি করতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভা পরিণতি লাভ করেছিল পল্লীবাংলার সঙ্গে এই ঘনিষ্ট সম্পর্কের ফলেই। এবং এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করে। জমিদার রবীন্দ্রনাথই ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডন্নাতর চরম শিখরে আরোহন করে। জমিদার রবীন্দ্রনাথই ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।